বিপ্লবীদের প্রেম করতে নেই || মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার
বিপ্লবীদের প্রেম করতে নেই || মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই ঠোঁট পুড়ে যাবার উপক্রম। আসলে আজ আমার আনমনা মন। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে একটু চিন্তিত হওয়ায় এমন হলো। সকাল সকাল আমার মন ভারাক্রান্ত। গতকাল থেকে হতাশা যেন জেঁকে বসেছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তাতে আমার কি! তারপরও আমি তো রাজনীতির বাইরে কেউ নই। এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘মানুষ মাত্রই সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীব। যে সমাজে বাস করে না, সে হয় পশু নয়তো দেবতা।’ আমি এ দুটোর কোনটিই নই। সুতরাং চলমান পরিস্থিতি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

গতকাল মিছিলের সামনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, রাতে তারাই নাকি গাঁ ঢাকা দিয়েছে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে এ পদ্ধতি বেছে নেওয়া। আমিও তাদের একজন। আসলে রাষ্ট্রযন্ত্র চলমান আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নেবে এটি স্বাভাবিক বিষয়। পুলিশ গতকাল টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করায় শতাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি। যদিও এসব খবর কেউ রাখে না। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কিছু টাকা তুলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। একটু পর আমাকে তাদের খোঁজ নিতে বের হতে হবে। হল ছাড়তে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। যে ক’জন আছে তারা হয়তো বাধ্য হয়ে আছে। আমিও তাদের মধ্যে একজন। পকেটে পাঁচ টাকার একটি জ্বীর্ণ নোট। হাতে নিতেই তার বেহাল দশা চোখে পড়ল। আসলে আমারও জীবন কেন জানি নোটটির মত বেহাল দশায় পার করছে। এসব ভাবতে ভাবতে কেন জানি নিজ পরিবারের কথা ভীষণ মনে পড়ছে।

মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম চিঠি। লিখব লিখব করে চিঠি লেখার সময় হচ্ছে না। পোস্ট অফিসে হয়ত আজ যাবার সময় চিঠি পোস্ট করে যাব। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। পড়াশোনা নিয়মিত চলছিল ঠিকঠাক। তবে অধিকার আদায়ে আমি ছোটবেলা থেকেই সোচ্চার। সরকার জনগণের উপর অন্যায় নীতি চাপিয়ে দিবে আর আমরা তা মাথা পেতে নিব, এমন তো হতে পারে না। জনগণের অধিকার আদায়ে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। আজ বিকেলে আমরা আবারো মিছিল করবো। রাতে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মুক্তির জন্য থানা ঘেরাও করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

চা শেষ হতে না হতেই হলের গেস্ট রুমে হাজির বন্ধু মমিন। সাথে তার হবু ভাবি স্বর্ণাকে নিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই আজ আমাকে মিছিলে যেতে বাঁধা দিবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং এর আশেপাশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিছিল মিটিংয়ে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। স্বর্ণার সাথে আমার সম্পর্ক বছর দুয়েক হবে। শহরের বড় ব্যবসায়ী তার বাবা। মেয়েটি দেখতে শুনতে যেমন সুন্দরী, তার চেয়ে বরং সে বেশি মায়াবী। আমি তার মায়ায় পড়েছিলাম প্রথম বর্ষে। যদিও সে আমার আবৃত্তি দারুণ পছন্দ করতো। ফলে দুজনের দূরত্ব ঘুচে একসময় একই সূতোয় গাঁথা হলো। আমার দারিদ্র তার কাছে কখনও গুরুত্ব বহন করেনি। অনেকটা বাংলা চলচ্চিত্রের গল্পের মত ধনি-দরিদ্রের মিলন। তার পরিবার আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না জেনেও সে আমার সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছে। মহীয়সী নারী বলে কথা।

স্বর্ণা মমিনকে পরামর্শক হিসেবে আমার কাছে এনেছে। সে জানে আমি তার প্রস্তাব অর্থাৎ আজ চলমান আন্দোলনে যাওয়া থেকে বিরত থাকবো না। মমিন আমার খুব কাছের বন্ধু। ফলে তার পরামর্শে হয়ত বা সে আমাকে রাজি করাতে সক্ষম হবে। সাদা রঙের গাড়িতে সে এসেছে। সাদা রং শান্তির প্রতীক তবে চলমান অবস্থা অশান্ত। আমার মন সমুদ্রের গর্জনের মত তীব্র বিপ্লবী রূপে রয়েছে। তবে অতি শান্ত হয়ে তাদের প্রস্তাবে অসম্মতি জানালাম। এতে দুজনেই আমার উপর মনক্ষুণ্ন। স্বর্ণার চোখে অশ্রু চলে এলো। আমার হাতটি ধরে বিনীত হয়ে বলল, তুমি আমার সাথে চল। একদিন না হয় আমাদের বাড়িতে থেকো। আমি সে প্রস্তাবে রাজি হতে পারলাম না। বিপ্লবীদের প্রেমে পড়তে মানা। তার পরও যদি প্রেম থেকেও থাকে তবে আবেগ থাকতে নেই। তার অশ্রু আমার মনে দাগ কাটলেও আমি অন্যায় আবদারের সাথে আপোস করতে পারি না। বিবর্ণ বদনে তারা দুজন হলের গেস্ট রুম থেকে প্রস্থান করলো।

আজ রাস্তা একদমই ফাঁকা। প্রেমিকার বিদায়ে মনকে সংযত করার পরিকল্পনা নিয়ে হাঁটছি। পকেটে মা-বাবার জন্য লেখা চিঠি রয়েছে। পোস্ট অফিসে চিঠিটি পোস্ট করে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে গানের দু’লাইন গেয়ে নিলাম, ‘বলবো না গো আর কোনদিন, ভালোবাসি তোমাকে’। আসলে মানুষ কেন জানি সুখে এবং দুঃখে উভয় সময়ে আনমনা থাকে। মনের অজান্তে গান গাওয়া হয়। আমি আবৃত্তি করতে পছন্দ করি। বিদ্রোহী মননে আবৃত্তি প্রদীপের শিখা হয়ে জ্বলে। তবে আজ শিল্প সংস্কৃতির বেহাল দশা। সামাজিক অবক্ষয় রুখবে কে, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় কেন জানি আর তরুণ সমাজ আগ্রহ দেখায় না। অবসরে আড্ডা চোখে পড়ে, তবে সে আড্ডা সৃষ্টিশীল নয়। তারা নেশার জগতে এক মায়াবী মুগ্ধতা খুঁজে পায়। তবে মিছিলে যারা আসে; তারা আজও সমাজ সভ্যতা ও ন্যায়কে ধরে রেখেছে। বিবেকের তাড়না এদের খেলা করে। হাসপাতালে যেতেই মনটা আরও ভারাক্রান্ত হলো। যাদের প্রাণবন্ত বিচরণ ক্যাম্পাসকে মাতিয়ে রাখতো আজ তাদের এমন চিত্র বড্ড কষ্ট দেয়। তার পরও বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। পরিস্থিতি আসলে অনেক কিছু তৈরি করে।

লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই, জয় বাংলা বাংলার জয়- এমন নানান স্লোগানে কেন জানি প্রকম্পিত হচ্ছে মন। আসলে ভাবনার জগৎ বড়ই রহস্যময়। নিজের অজান্তে সে মনে প্রভাব বিস্তার করে। যে মনে ভাবনার জায়গা দখল করে ছিল স্বর্ণা, আজ সে জায়গা অন্য কারও। মন এমনি, যার প্রভাব বেশি থাকবে; সে তার জায়গা করে নিবে। ব্যক্তির নিজের নিয়ন্ত্রণ তার মনে থাকে না।

টিএসসির কাছেই ছোট জটলা চোখে পড়লো। আমি কাছে যেতেই তারা আমাকে পাশে ডেকে নিলো। এরা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমার আসার জন্য তারা অপেক্ষা করছিলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার কাছে পরামর্শ চাইলো, আজ তারা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করতে চায়। ৫২ তে জরুরি অবস্থা ভেঙে মিছিল করার সে স্মৃতি আমার মনে দাগ কেটে গেল। সবগুলো তরুণ তাজা প্রাণ। আসার সময় পুলিশের সরব উপস্থিতি দেখে এসেছি। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের বুকে পুলিশ গুলি চালালে তাদের পরিবার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। একেকটি মুখ একেকটি স্বপ্ন। তবে তারা ঝুঁকি নিতে চায়। বাস্তবতা এমনি, অধিকার আদায়ের প্রধান শর্ত রক্ত দিতে হবে। রক্ত না ঝরালে কিছুই পাওয়া যায় না।

স্বপ্ন এদের দেখা মানায়। ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে। মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। তারুণ্য শক্তি এমনি কোন বাধা মানে না। রাজপথে আজ মিছিল হবে। আমাকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। মা-বাবার কথা কেন জানি বড্ড মনে পড়ছে। মিছিলের পূর্বে আমার মনোরাজ্য তাদের দখলে। তার পরও যেতে হবে। অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। নিজের স্বার্থকে বলিদান করতে হবে। ওরা ব্যানার আর প্লাকার্ড নিয়ে আমাকে সামনের সারিতে দিল। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হলো ক্যাম্পাস। রাজপথে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে আমরা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে থানা ঘেরাও করবো। আমাদের মিছিল ছুটে চলছে। এ যেন এক তারুণ্যের জোয়ার। দাবি আদায়ে তারা সোচ্চার।

মিছিল এগিয়ে চলছে, আমি সামনের সারিতে। আশেপাশে আমার হলের ছোটভাই আছে কয়েকজন। পুলিশ ব্যারিকেডের কাছাকাছি আমরা পৌঁছতেই বিকট শব্দ কানে লাগলো। টিয়ারসেল নিক্ষেপ হলো, কয়েক রাউন্ড গুলিও বর্ষণ হলো। তারপর আর্তনাদের শব্দ ভেসে এলো কানে। বুঝতে পারলাম মানুষের ছোটাছুটি চলছে। আমি শুয়ে পড়লাম পিচঢালা রাস্তায়। নিজের চোখটাও কেন জানি আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। চোখ জ্বলছে আর অঝোরে পানি পড়ছে, হাতের বাঁপাশে কেমন যেন জ্বলে, রক্ত ঝরছে। নিজেকে আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আর্তনাদ করতে ইচ্ছা করছে। তবে আর্তনাদ করা বিপ্লবীদের শোভা পায় না। বিপ্লবীদের সবকিছু হাসিমুখে বরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


সাবস্ক্রাইব করুন! মেইল দ্বারা নিউজ আপডেট পান